|
অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবেও জামায়াতকে পরাজিত করতে হবে।
.
স্বাধীনতা সহজে প্রাপ্য নয়। বীরের রক্তস্রোতোধারা, মাতার দুঃখ, কন্যার অশ্রু ও অসংখ্য আত্মত্যাগের মাধ্যমেই সর্বত্র স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং অর্জিত স্বাধীনতাও এর ব্যতিক্রম নয়।
কিন্তু তার চেয়েও বড় সত্য হচ্ছে স্বাধীনতা রক্ষা করা, তাকে অর্থবহ করা এবং তাকে আরও গৌরবদীপ্ত করে সব নাগরিকের হৃদয়ে তাকে প্রতিষ্ঠিত করা স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে শত শত গুণ কঠিন কাজ। স্বাধীনতা যদি নিছক পতাকা বদল, মানচিত্র বদল, ক্ষমতার হাতবদল হতো, তাহলে স্বাধীনতা অর্জনের পর তাকে রক্ষা করাটা তেমন কঠিন কাজ হতো না।
.
এটি হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের দল ‘জামায়াতে ইসলাম’। এই দলটি মৌলবাদী কিন্তু ভয়ানক ধূর্ত ও কৌশলী একটি দল। এই দলের সঙ্গে পুঁজিবাদের কোনো শত্রুতা নেই। তাদের অনেক নেতাই পুঁজিপতি। আমেরিকানরা এই দলকে দেশে দেশে ব্যবহার করেছে প্রগতিশীলদের বিরুদ্ধে বহুবার। এ জন্যই সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন বাংলাদেশের জামায়াতকে মডারেট ইসলামিক পার্টির সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। এরা মূলত বিএনপির ধর্মভিত্তিক ভারতবিরোধী জাতীয়তাবাদকে পছন্দ করলেও সুবিধা দেখলে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদকেও নিজেদের কাজে লাগায়। তাদের ‘ওয়েবসাইট’ পরিদর্শন করলে আপনি দেখবেন সেখানে একটি সহযোগী সদস্যপদের ফরম আছে এবং সেটি অমুসলমানদের জন্যও উন্মুক্ত বলে দাবি করা হয়েছে। সেখানে যদিও প্রথমে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে শুরু করা হয়েছে, কিন্তু পরে দরখাস্তের ভেতরে তাকে যেসব শর্ত পূরণের কথা বলা হয়েছে, তাতে কোথাও সুনির্দিষ্টভাবে ‘ইসলাম’ ধর্মের কথাই নেই!
.
মশিউল আলম লিখিত গ্রন্থ উইকিলিকসে বাংলাদেশ থেকে জানা যায় যে এই দলের অন্যতম নেতা ব্যারিস্টার রাজ্জাক মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাছে গিয়ে আগেই ‘মিনতি’ জানিয়ে এসেছেন যে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র খর্ব করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হলে তাদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের সুযোগ থাকবে না এবং নাইন-ইলেভেনের মতো জঙ্গি তৎপরতা তখন বৃদ্ধি পেতে পারে, যেটা আমেরিকার জন্যও ক্ষতিকর হবে, আর সে জন্যই মার্কিন রাষ্ট্রদূতের উচিত হবে আওয়ামী লীগকে বোঝানো, যাতে জামায়াতকে বেআইনি করা না হয়।
.
কিন্তু জামায়াত কি গণতান্ত্রিক দল? মার্কিনরা কি নাৎসি দলকে গণতান্ত্রিক দল বলেন? মনে রাখা উচিত জামায়াত এমন একটি দল, যেখানে তৈরি হয়েছিল একাত্তরের খুনিরা। যে দল এখনো একাত্তরে তাদের ভূমিকাকে কোনো অন্যায় বলে মনে করে না এবং জঙ্গিদের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতাও আমাদের অজানা নয়। জামায়াতের শাখা-প্রশাখাও বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে। তাই যখন বাংলাদেশে জামায়াতের নেতা নিজামীর ফাঁসির আদেশ ঘোষিত হলো তখন দেখা গেল, পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামের আমির সিরাজুল হক বিবৃতি দিয়ে তাদের পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন।
.
প্রকৃত সত্য হচ্ছে, যেসব দালাল যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁরা অধিকাংশই বন্দী ছিলেন এবং কারও কারও ক্ষেত্রে বিচারও শুরু হয়েছিল। দুর্ভাগ্য হচ্ছে জেনারেল জিয়া একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়েও এই দালালদের পুনর্বাসন শুরু করেন। আর মুক্ত হওয়ার পর এঁরা দক্ষতার সঙ্গে সংগঠন এবং নিজস্ব পুঁজির বিকাশ ঘটিয়েছেন।
.
আজ তাই নিছক পুঁজিবাদী বিকাশের অভিঘাতে বাংলাদেশ থেকে জামায়াতের অভিশাপ দূর হবে না। বরং মৌলবাদী ধর্মীয় চিন্তা যখন পুঁজি ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর ভিত্তি করে সামনে এগোয়, তখন তাকে কিছুতেই খাটো করে নিছক সামন্তবাদের অবশেষ হিসেবে দেখলে চলবে না। বিচার ও শাস্তি প্রদানের পাশাপাশি অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবেও জামায়াতকে পরাজিত করতে হবে।
.
এম এম আকাশ: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
Categories: Open Mind
The words you entered did not match the given text. Please try again.
If you are the site owner, please renew your premium subscription or contact support.
Oops!
Oops, you forgot something.