|
বিচিত্র এই দেশ!
.
গত কয়েক দিনে আদালতের রায়ে মতিউর রহমান নিজামী ও মীর কাসেম আলী যুদ্ধাপরাধের জন্য দোষী প্রমাণিত হয়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। আর আমাদের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ আরেক যুদ্ধাপরাধীর দোষ ও সাজা বহাল রেখেছেন, অর্থাৎ কামারুজ্জামানকে দেওয়া যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল রেখেছেন।
.
মানুষ মাত্রই ভুল করতে পারে, অন্যায় করতে পারে, অপরাধ করতে পারে; এমনকি নৃশংস-নির্মম-জঘন্য যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধ করতে পারে। কিন্তু এত খারাপ কাজ করলেও, মানুষের তো বিবেক থাকার কথা। মনুষ্যত্বের একটা দিক নিশ্চয় ‘বিবেকের দংশন’। যত বড় অপরাধীই হোক না কেন, এটা ধরে নেওয়া স্বাভাবিক যে কোনো একদিন সেই অপরাধীও বিবেকের দংশনে জর্জরিত না হলেও কিছুটা হলে প্রায়শ্চিত্তবোধ তার হবে। মনে মনে হলেও দুঃখিত, লজ্জিত হবে; কিছুটা হলে অনুশোচনা বোধ হবে। তার নৃশংসতা, জঘন্যতা, বর্বরতার শিকার ব্যক্তিদের জন্য মানবিক কিছু চিন্তাধারণা হবে। কিন্তু এই এক সপ্তাহের তিনটা রায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু ঘটনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে শুধু এই যুদ্ধাপরাধীরাই নন, তাঁদের সাঙ্গপাঙ্গদের অনেকেই তাঁদের মতো বিবেকহীন, ভয়ংকর ও ভয়ানক।
.
যেকোনো মৃত ব্যক্তির শেষ ইচ্ছা পূরণে সাধ্যমতো চেষ্টা করা অবশ্যই করণীয়। কিন্তু শেষ ইচ্ছাটা যদি বীভৎস ও ভয়ংকর হয়? গোলাম আযমের শেষ ইচ্ছা ছিল, সংবাদমাধ্যমে কথাটা যেভাবে এসেছে, সেটার ওপর নির্ভর করছি: দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী অথবা মতিউর রহমান নিজামী তাঁর জানাজা পড়াবেন।
.
বিবেকের দর্শন, প্রায়শ্চিত্ত, অনুশোচনা ইত্যাদির খাতায় নিঃসন্দেহে শূন্য। সাঈদীর ট্রাইব্যুনালে বিচার হয়েছিল অনেক আগে। আপিল বিভাগও রায় দিয়েছেন বেশ কয়েক সপ্তাহ আগে। আমৃত্যু কারাদণ্ড। অর্থাৎ আমাদের সর্বোচ্চ আদালত শেষ সিদ্ধান্ত দিয়ে দিয়েছেন। স্পষ্টত গোলাম আযম যখন সাঈদীর পড়া জানাজার পর কবরে শায়িত হতে চেয়েছিলেন, এটা মনে করাই স্বাভাবিক যে গোলাম আযম সাঈদীকে পূতপবিত্র পরহেজগার ব্যক্তি মনে করতেন, শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত।
কী ভয়ংকর, বীভৎস মনমানসিকতা! নিঃসন্দেহে চিন্তাচেতনা অনেকটা এ রকম, তোমাদের আইন বিচার যা-ই বলুক না কেন, আমরা হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষ হত্যা করলেও, ধর্ষণ করলেও, অগ্নিসংযোগ করে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিলেও খারাপ কাজ তো কিছুই করিনি। তাই সাঈদী বা নিজামীর মতো লোকেরা এসব কাজ করলেও খারাপ তো কিছু করেননি। গোলাম আযম যেন ঘোষণা দিয়েই বলছেন, সাঈদী-নিজামীর মতো পূতপবিত্র-পরহেজগার বান্দারাই আমার জানাজা পড়াবেন।
.
হায় আল্লাহ! এঁরাই নাকি এ দেশে আমাদের ধর্মের দিশারি। আমরা নাকি এঁদের কাছ থেকে ধর্ম শিখব!
মীর কাসেম আলী রায় ঘোষণার পর ‘ভি সাইন’ দেখিয়েছেন। স্পষ্টতই ভাবখানা হলো হাজার লোক মেরেছি তো কী হয়েছে, পারলে আরও মারতাম, মারব! দোষী ঘোষিত হওয়ার পর তাঁর মতো আরও অনেকেই এই ‘ভি সাইন’ দেখিয়েছেন রায় শোনার পর। যুদ্ধাপরাধীরা ক্রমাগত মনে করিয়ে দিয়ে চলেছেন যে তাঁরা এই রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের আইন, বিচার—কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করেন না। ১৯৭১ সালে তাঁরা যে কোনো অপরাধ করেছিলেন, সেটাও স্বীকার করেন না। মরে গিয়েও সেই একই ঘোষণা দিয়ে গেলেন, জানাজার ইমামতি করবে যুদ্ধাপরাধী।
.
জিম্মি হয়ে ঘরে বসে আছি সেই ৩০ অক্টোবর থেকে। স্পষ্টত ১৯৭১ সালের পর ৪৩ বছরে এখনো এসব খুনি-যুদ্ধাপরাধী-মানবতাবিরোধী অপরাধীরা হরতালের নামে গোটা বাংলাদেশকে জিম্মি করে রেখেছে। পুরো সপ্তাহ ধরে তারা আমাদের গৃহবন্দী করে রেখেছে। কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে অনেকে বেরোচ্ছে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের ধৃষ্টতায় অধম অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। রাজনৈতিক কারণে, অর্থনৈতিক নীতি বা সিদ্ধান্ত বা অন্য অনেক কিছুতেই হরতাল হতে পারে। তবে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচারে এবং সে বিচারে রায়ের বিরুদ্ধে যে দল হরতাল ডাকে, তারা নিঃসন্দেহে আইনকানুন, বিচার-আদালত, ন্যায়-অন্যায় কিছুরই তোয়াক্কা করে না।
.
অবশ্য এটাও স্পষ্ট যে যত দিন এ দেশের মানুষ দরিদ্র-অশিক্ষিত থাকবে, তত দিন ধর্ম বিকিয়ে যারা তথাকথিত রাজনীতি করে, তাদের প্রভাব থাকবে। পিছিয়ে পড়া মানুষই তাদের ভরসা-সম্বল। অর্থনীতিটাকে যতই এগোতে না দেওয়া যায়, তাদের জন্য ততটাই মঙ্গল। দারিদ্র্য-অশিক্ষা-কুশিক্ষা দূর করতে যত বেশি সময় লাগবে, ততই তাদের লাভ। তাই দিনের পর দিন তারা হরতাল ডাকবে। আমাদের জিম্মি-বন্দী করে রাখবে। আর আমরা কিছুই করতে পারছি না।
.
সরকার একটা সুবর্ণ সুযোগ হারাচ্ছে। হরতালকে কেন্দ্র করে, বিশেষত রায়ের কারণে হরতাল ডেকে জামায়াত যে সাংঘাতিক জনবিরোধী কাজ করছে, সেটা সরকার কাজে লাগাতে পারছে না। দিনের পর দিন যুদ্ধাপরাধী-মানবতাবিরোধী রায়ে ঘোষিত জঘন্যতম অপরাধীরা হরতালের নামে আমাদের জিম্মি-বন্দী করে রাখছে। আমরা কিছুই করতে পারছি না। আর অদক্ষ সরকার বুঝতেও পারছে না শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষের মত কীভাবে কাজে লাগাবে।
.
বিচিত্র এই দেশ!
.
ড. শাহদীন মালিক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট; অধ্যাপক, স্কুল অব ল, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি
Categories: Open Mind
The words you entered did not match the given text. Please try again.
If you are the site owner, please renew your premium subscription or contact support.
Oops!
Oops, you forgot something.