|
গালাগালির মালা – গালির রাজা ”রাজাকার”
মোল্লা বাহাউদ্দিন
.
গালি নিয়ে কোন সাহিত্য তো হয়ই না এমনকি কারও সাথে গল্পও করা যায় না। এটা অসভ্য কাজকর্ম। বুঝলাম অনেক দেরীতে। তারপরও আমাদের মরম আলির কথা বলতে ইচ্ছে হয়। গল্পই হোক বা অসভ্যতাই হোক একবার বলেই দেখি কি হয়। হয়ত আমাকে অনেক গালাগালি শুনতে হবে।
।
পৃথিবীর সব দেশের সব মানুষই কোন কারনে কোন সময় কোন গালি বর্ষন করে থাকে। কেউ যখন কারও উপর খুব রেগে যায় এবং হাতের কাছে পায় না অথবা হাতের কাছে পেয়েও হাত ব্যবহার করতে পারে না তখনই মনের ঝাল গালি বর্ষন করে কিছুটা হলেও লাঘব করে। অনেকে গালি বর্ষন করেই শান্তি পায়। মনে করে আর তো কিছু করতে পারলাম না, কয়েকটা গালিই দিয়ে দেই। মনে করে গালির মাধ্যমেই যথেষ্ট শাস্তি দেয়া হয়েছে। অনেকে গালি দিয়ে শাসন ও করে থাকে। তা হল হালকা ধরনের গালি। এসব গালিতে কেউ রাগ করেনা।
।
সব দেশের সব গালিরই একটা অর্থ আছে। প্রত্যেক দেশের প্রত্যেক ভাষার গালির অর্থ করলে যা দাড়ায় তা হলো গোপন অংগের বিশেষ বিশেষ অংশ নিয়ে তার সাথে বিশেষ্য, বিশেষন, সর্বনাম ইত্যাদি সংমিশ্রন করে এবং সেই অঙগ লক্ষ করে অশ্রাব্য পঙতিমালা বুলেটের মত ছুড়ে দেয়া। আর সে বিশেষ স্থানগুলো হলো মা বোন বা জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে। কারন মানুষ এই তিনটা জিনিষের প্রতি দুর্বল। এই তিনটা স্থানে কেউ আঘাত করলে বা নাক গলালেই মানুষ উত্তেজিত হয়ে পড়ে, প্রয়োজনে খুন করে। যেমন ধরুন একজনকে কুত্তা বলে গালি দিলে সে বেশি চটবে না, কিন্তু যদি কুত্তার বাচ্চা বলা হয় তাহলেই সে ক্ষেপে যাবে। কারন তার জন্মদাতাকে গালি দিলে সে সহ্য করবে না। তেমনি মা এবং বোন হল সবচেয়ে ভালবাসার, আদরের, শ্রদ্ধার পাত্রি। তাদের নিয়ে কেউ কটুবাক্য বললে সে সহ্য করবে না। তাই এই দুর্বল এবং স্পর্শকাতর জিনিষ নিয়েই গালাগালির সৃষ্টি।
.
গালাগালিকে কয়েক শ্রেনীতে বিভক্ত করা যায়। যেমন শহুরে আর গ্রাম্য গালাগালি। শহরের গালাগালি একটু উচুঁস্তরের, আর গ্রামের গালাগালি একবারে গ্রাম্য শব্দের সংমিশ্রন।
।
মরম আলি আমাদের গ্রামের একজন সরল সোজা মানুষ। তার গায়ের রং বাঙালিদের মাঝে দেখা যায় না। সারাদিন রোদে পুরে তার গায়ের রং তামাটে হয়ে গেছে। অনেকে বলে তার পূর্বপুরুষ এসেছিল কাবুল না কোন দেশ থেকে। যাকগে সে কথা। মরম আলি আমাদের গ্রামের বাসিন্দা কয়েক পুরুষ থেকে। তার কাজ হল সকালে ক্ষেতে যাওয়া, বিকেলে বাড়ী ফিরে গরু ছাগল ঠিক ঠিকভাবে গোয়ালে রাখা, খাবার দেয়া। নিজে খেয়ে রাতে ঘুমিয়ে সকালে আবার সেই কাজ। সে পৃথিবীর কোন সাতে পাঁচে নেই। কারও সাথে ফালতু কথা বলার সময়ও তার নেই। তার যা ফসলি জমি আছে তা নিয়ে সে খুব সুখে আছে। কারও সাথে কোন লেনদেন নেই।
।
মরম আলি সব সময় খেত পাহাড়া দিতে পারে না। তবে প্রতিদিন একবার হলেও দেখতে যায়। আর গিয়ে দেখে প্রায় প্রতিদিন কিছু না কিছু কামড় আছে। তখনই সে দাড়িয়ে পরে। তার পরনে থাকে একটা গামছা, আর মাথায় বাধা থাকে আর একটা। সে খেতের আলে দাড়িয়ে খুলে দেয় তার গালির ভান্ডার। একটা মালার মত। যেমন কথার মালা, ফুলের মালা ইত্যাদি। প্রথমেই সে শুরু করে চুতমারানির পুতাইত, (পুতাইত মানে পুত্ররা বরগিরির (বরগিরি কি আমার জানা নেই
পুতাইত, ...মারানির পুতাইত, ....নির পুতাইত, তর মায়রে .., তর বইনেরে ... ইত্যাদি শব্দগুলো শেষ হয়ে গেলে আবার প্রথমটা থেকে শুরু করে। তার মুখস্ত। কোনটার পর কোনটা হবে সে জানে। ভুলেও একটা শব্দ আগে পরে হয় না। এমন জোড়ে জোড়ে চিৎকার করে বলে যায় যেন গ্রামের সব মানুষ শুনতে পায়। কারন সে জানে না কার গরু তার খেতে কামড় দিয়েছে। যার গরুতে কামড় দিয়েছে তার কানে কোন রকমে পৌছাতেই পারলেই তার গালাগালি সার্থক। এই গালির মালাটা চলবে ঘন্টার পর ঘন্টা। এক সময় তার মুখ দিয়ে ফেনা বেরোবে। তখন সে গামছা বদল করবে। মাথার গামছাটা পড়বে আর পরনের গামছাটা মাথায় বাধবে। এর কি শানে নজুল তা কেউ জানে না। গামছা বদল করে আবার শুরু হবে গালি বর্ষন। প্রথমে হাত নেড়ে, তারপর কোমড়ে হাত রেখে, আরও ক্লান্ত হয়ে বসে পড়বে। হাপাতে হাপাতে অনেকটা সুর করে মালা জপতে থাকে। বেলা ডুবলে সে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে।
।
১৯৭১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি একদিন দুপুরে মরম আলী খেতে গেছে। দূর থেকেই দেখতে পেল খেতে কামড় নয় স্বয়ং দু দুটা বলদ খুব আয়েস করে তার খেত খেয়ে যাচ্ছে। ধারে কাছে কেউ নেই। এক দৌড়ে সে খেতের আলে যেতেই শুনতে পেল চারদিক থেকে গোলাগুলির শব্দ আসছে। এমন শব্দ সে আগেও শুনেছে। তবে তা ছিল অনেক দূরে - সি এন্ড বি সড়কের ওপারে। রাত দিন অনবরত গুলির শব্দ শুনে আসছে সে। গুলা গুলি যে কত ভয়াবহ হতে পারে তার সে ধারন ছিলনা। এখন কত কাছ থেকে শব্দ আসছে তা সে বুজতে পারেনি। তাছাড়া খেত রক্ষা করার চেয়ে গুলির শব্দ জরুরি নয়। তাই সে তার গালির ভান্ডার খুলে দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সে তাকিয়ে দেখল বিলের দক্ষিন দিক দিয়ে অনেক মানুষ দৌড়ে ইন্ডিয়ার দিকে যাচেছ। যেন প্রতিযোগিতা চলছে। সকলেই ছুটছে। প্রানের ভয়ে। কেউ কারও দিকে তাকচ্ছেনা। শুধু মালেক তার আশি বছরের মাকে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। যেন এখনি ফাসিতে ঝুলাবে। বৃদ্বার এক হাতে লাঠি, আর এক হাত মালেকের হাতে। মালেক যখন তার মাকে কাধে নিয়ে ছুটে চলল, মরম আলী তখন বুঝতে পারল বিপদ আসন্ন, তাকেও দৌড় দিতে হবে। সে শুনেছে বিল পেরিয়ে শৈতপুর পৌছতে পারলেই আর কোন ভয় নেই। এখন খেত রক্ষা করবে নাকি দৌড় দিবে তা ঠিক করতে পারছেনা। গোলাগুলির শব্দ আরও বাড়ছে। মনে হ্েচ্ছ খুব কাছ থেকে আসছে। আলফাজুদ্দি নৌকায় অনেকগুলি মানুষ নিয়ে ধলাই বিল কোনাকুনি পাড়ি দিচ্ছে। রাজনগরের রশিদও বিলের দক্ষিন দিক দিয়ে প্রানপনে ছুটছে! আরে একি! একটা গরু যে এমনিতেই পড়ে গেল। বিলের দিকে তাকিয়ে দেখল আফাজের নৌকা আর চলছে না। মানুষগুলো যে যেভাবে পারে সাতরে যাচ্ছে। আর একটা গরু পড়ে যেতেই তার মুখ দিয়ে একটা গালি বেরিয়ে গেল। কোন্ চুতমারানির পুতরে! গরুগুলিরে মাইরা ফালাইলি? খেত খাইছে আমার, তরা মারনের কে? সে গালাগালি করতে পারে। তাই বলে গরু মেরে ফেলা কিছুতেই মানবে না। অবলা জীব। গরুকে সে কোনদিনই গালি দেয়নি। কোন শাস্তিও দেয়নি। শাস্তি হবে মালিকের। গরু মারা অণ্যায়। গুলি করার আর জায়গা পাইলি না? বরগিরির পুতাইত.... তার চোখ গেল বিলের দক্ষিন দিকে। আরে রশিদও তো পইরা গেল। সে ততক্ষনাত দৌড় দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মাথার গামছাটা হাতে নিয়ে দৌড় দিতেই একটা গুলি তার বুক এফোড় ওফোড় করে দিল। একটা গরুর পাশেই ঢলে পড়ল সে।
।
এখানে, এই এলাকায় জল্লাদ বাহিনীর পৌছার কথা ছিলনা। ছিলনা মানে সকলের ধারনা ছিল এত সব খাল বিল মুড়া জঙ্গল পেরিয়ে ওরা পৌছতে পারবে না। এপ্রিল পর্যন্ত সবাই খুব শান্তিতে ছিল। ইন্ডিয়া বাংলাদেশের কোন সীমানা ছিল না। যেন এক দেশ এক ভাষা এক বেশ। অনেকে মনে মনে ভাবত এভাবে থাকলেই তো ভাল। বিশেষ করে যেসব নেতারা বাড়ী গাড়ি অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নিয়ে ছিল তারা তো চেয়েছিল দেশ স্বাধীন না হলেই ভাল! কিন্তু দেশ স্বাধীন হল।
।
আজ মরম আলি নেই, ধলাই পারে তার গালির তীব্র আওয়াজ আর শোনা যায় না। সে বেচেঁ থাকলে দেখতে পেত তার গালির ভান্ডার এখন ভোতা হয়ে গেছে। এখন বিশ্বে সব গালি ছাড়িযে একমাত্র একটা গালিই বুলেটের মত কাজ করে। আর সেটা হল ”রাজাকার”। আমরা তার সাগরেদরা একমাত্র এই গালিটা ছুড়ে দিয়ে থাকি যার প্রাপ্য তার দিকে। তাতে যথেষ্ট কাজ হয়। আর কোন গালিই এমন তীরের ফলার মত তরিৎ গতিতে এফোড় ওফোড় করে দিয়ে যায় না
Categories: Brief Stories, Part -1
The words you entered did not match the given text. Please try again.
If you are the site owner, please renew your premium subscription or contact support.
Oops!
Oops, you forgot something.