|
রাজনীতিবিদের সন্তানরা রাজনীতি না করেই রাজনীতিবিদ হয়ে যায়।
ছাত্ররাজনীতি রাজনীতিবিদদের অস্ত্র কেন্ত্র । - রিপন
।
এ দেশে একটা সময় ছাত্রসংগঠনগুলো ছিল স্বাধীন। অনেক ছাত্রসংগঠন জাতীয়ভিত্তিক রাজনৈতিক দলের সমর্থক ও সহযাত্রী হলেও তাদের মধ্যে সম্পর্ক হতো অনানুষ্ঠানিক। যেমন ছাত্রলীগ ছিল আওয়ামী লীগের সহগামী। অন্যদিকে ছাত্র ইউনিয়ন ছিল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সহযোগী। বিপত্তি বাধায় জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি এই সংগঠনটিকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনেম খান নিজের পকেটে পুরে ফেলেন। ক্যাম্পাসে যদি একটি সংগঠন সরকারের পেটোয়া বাহিনী হয়ে যায়, তখন আর সুস্থ রাজনীতি থাকে না। জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন বা এনএসএফ এ দেশের ছাত্ররাজনীতিতে যে ধারার প্রবর্তন করেছিল, পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগ একই ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। ১৯৭৩ সালে ডাকসুর ব্যালট বাক্স ছিনতাই করার মধ্য দিয়ে তারা কুদৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। পরবর্তী সময়ে বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলও শিক্ষাঙ্গনে জবরদখলের ধারা বজায় রাখে। জিয়াউর রহমানের সেনাশাসনে একটা পরিবর্তন আনা হয়েছিল। তখন রাজনৈতিক দলবিধি জারি করা হয় এবং ছাত্রসংগঠনগুলোকে রাজনৈতিক দলগুলোর শাখা হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে হয়েছিল। সেই ট্র্যাডিশন চলছে এখনো।
.
এ দেশে যখন নিয়মিত ছাত্র সংসদের নির্বাচন হতো, তখন যে সব সময় সত্যিকার ছাত্ররাই নির্বাচিত হতেন, তা নয়। অনেকেই নির্বাচন করার জন্য বছরের পর বছর ছাত্র থেকে যেতেন। একটা উদাহরণ দিই। মাহমুদুর রহমান মান্না ঢাকা কলেজে আমার এক ক্লাস ওপরে পড়তেন। ওবায়দুল কাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার দুই বছর সিনিয়র ছিলেন। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব শেষ করার পাঁচ বছর পরেও দেখেছি তাঁরা দোর্দণ্ড প্রতাপে ছাত্রত্ব বজায় রেখে চলেছেন এবং ডাকসুর নির্বাচন করেছেন। এটাও ছাত্রসংগঠনগুলোর একধরনের দেউলিয়াপনা।
.
পাঠ্যক্রমের বাইরে নানা সৃজনশীল কাজের মধ্যে থেকেও একজন ছাত্র নানা গুণের অধিকারী হতে পারেন। এখানে আমি আরেকটা উদাহরণ দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। হ্ুমায়ূন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সিনিয়র ছাত্র ছিলেন। তাঁকে জীবনে কোনো দিন কোনো মিটিং-মিছিলে অংশ নিতে দেখিনি। ইউনিভার্সিটির হলের করিডরে মিছিল হলে অনেক ‘ভালো ছাত্র’ দরজা বন্ধ করে বাতি নিভিয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতেন, যাতে অন্যরা তাঁদের মিছিলে যাওয়ার জন্য টানাটানি না করেন। হ্ুমায়ূন ছিলেন ওই রকম একজন ছাত্র। রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে লেখাপড়ার ক্ষতি হোক, এটা তিনি চাইতেন না। পরে তিনি দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হতে পেরেছিলেন। আর ওই সময়ের অনেক সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মী এখনো ভবঘুরের মতো জীবনযাপন করেন।
.
যাঁরা প্রবল প্রতাপে রাজনীতির মাঠ কাঁপিয়েছেন বা এখনো কাঁপাচ্ছেন, ব্যতিক্রম বাদে তাঁরা কেউই সন্তানদের ছাত্ররাজনীতিতে আনেননি। তাঁরা সময় ও সুযোগমতো তাঁদের সন্তানদের বিদেশে পাঠিয়ে দেন ‘উচ্চশিক্ষা’ নিতে, অথবা দেশেই রেখে দেন ব্যবসাপাতি করার জন্য। যখন সময় হয়, যখন তাঁদের শরীর-স্বাস্থ্যে কুলোয় না কিংবা যখন তাঁরা ইন্তেকাল করেন, তখন তাঁদের সুযোগ্য সন্তানেরা উত্তরাধিকার সূত্রে মা-বাবার নির্বাচনী এলাকাটির মালিকানা পেয়ে যান। যেসব নেতা-নেত্রী ছাত্ররাজনীতির ‘নোংরা কাদা’ তাঁদের সন্তানদের গায়ে লাগতে দেন না, তাঁরা তাঁদের রাজনীতিতে কামানের খোরাক হিসেবে ব্যবহার করেন অন্যের সন্তানদের। এই প্রবণতা ডান, বাম, মধ্য সব রঙের রাজনীতিকদের মধ্যেই দেখা যায়।
.
একটা সময় ছিল, যখন এ দেশে শিল্পকারখানা ছিল না, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তেমন একটা গড়ে ওঠেনি, একমাত্র আইন ব্যবসাই ছিল রাজনীতিকদের প্রধান পেশা। তাই রাজনীতিকদের মধ্যে আইন ব্যবসায়ীর ছড়াছড়ি দেখা যেত। সময় বদলে গেছে। এখন যাঁরা ইট-পাথর কিংবা আলু-পটোলের ব্যবসা করেন, তাঁরাও রাজনীতিতে আসছেন। এটাকে অনেক আইন ব্যবসায়ী বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ার নমুনা হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু ইট-পাথর-আলু-পটোল ব্যবসায়ীদেরও যুক্তি আছে। তাঁরা মনে করেন, তাঁদের চাঁদায় যদি অন্যরা রাজনীতি করেন, পার্লামেন্টে আস্তিন গুটিয়ে হাঁকডাক করতে পারেন, তাহলে তাঁরাই বা পিছিয়ে থাকবেন কেন? প্রতিযোগিতামূলক বাজারে এটাই তো স্বাভাবিক।
আমাদের দেশে রাজনীতি অন্যান্য শিল্প-ব্যবসার মতোই এখন একটি লাভজনক বিনিয়োগ।
.
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com
https://www.youtube.com/watch?v=q8ERK8yYXAo
Categories: Open Mind
The words you entered did not match the given text. Please try again.
If you are the site owner, please renew your premium subscription or contact support.
Oops!
Oops, you forgot something.