|
জ্ঞানীরা দেখেন, ভিতরের চোখে দিব্য দৃষ্টিতে। পণ্ডিতরা, দেখে চলছেন কেবলই বাহিরে চোখে।
.
পণ্ডিতরা স্রষ্টা নন। সৃষ্টি করার যোগ্যতা তাঁদের নেই, তবে তাঁরা যোগ্যতা-সম্পন্ন এই মর্মে যে, তাঁদের ঝুলিতে অনেক কিছু আছে, এবং তা বাহিরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জ্ঞানের-ই গ্রন্থসম। পণ্ডিতরা, বাহিরে খুঁজেন, বাহিরের জগত নিয়ে তাঁদের সাধনা। ইতিহাসের অনেক ঘটনাবলী যা কালের আবর্তনে মানুষের মন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বা যথারীতি চলে গিয়েছে, সে-সকল ঘটনাগুচ্ছের সন-তারিখ পর্যন্ত পণ্ডিতরা বলতে সক্ষম হয়ে থাকেন। কিন্তু পাণ্ডিত্য একটি শুষ্ক অবস্থা !! কেননা, ঘরের খবর যে জানে না, সে বাহিরের খবর নিয়ে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে গিয়েই বুঝতে পারে, কোথায় যেন আটকাচ্ছে। আটকানোর-ই কথা। বাহিরের চোখ বাহির-ই দেখে, সে সঠিক বলে মেনে নিলেও, তার সত্যতা আসে মন-চোখের বিচারের পর। এখানেই ধরা খেয়ে যান, পণ্ডিতের দল।
.
কিন্তু যে বা যাঁরা জ্ঞানী, তাঁদের নিয়ে ভিন্ন কথা। একজন জ্ঞানীর নিকট প্রশ্ন করে হয়ত জানা যাবে না, আজ থেকে দু-হাজার বছর পূর্বে অমুক নগরীর উৎপত্তি হয়েছিল কি না, তমুক নগরী ধ্বংস হয়েছিল কি না? অমুক দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল কি না, তমুক জাতি অমুক জাতির উপর অত্যাচার করে, কত মানুষ মেরেছিল? এসব ক্ষেত্রে জ্ঞানী পিছিয়ে থাকতে পারেন। আর এখানে দেখা যাবে, পণ্ডিতরা এগিয়ে আছেন। অনেকের নিকট থেকে শোনা যাবে মুখস্থ-বিদ্যার মতোই। ইতিহাসের বড় বড় ঘটনাবলীর আলোচনা বা পর্যালোচনা পণ্ডিতরাই করে থাকেন। সে-সব দিকে জ্ঞানীদের যেন ইচ্ছার-ও অভাব রয়েছে। কারণ, জ্ঞানীরা অপরের বমি চেটেপুটে খান না। নিজেকেই আবিস্কারের নেশায় মত্ত থাকেন এবং নিজেকেই তোলে ধরেন। যেন নিজেই নিজের গ্রন্থ। আর তাই পাঠ করে জগতকে শোনান। যদি কোনো কিছু চলন্ত না থাকে, তবে রোদ্দুরে কোনো ছায়াকে চলন্ত দেখা যাবে না। যদি ছায়াকেও দেখতে হয়, তথাপি ছায়া সৃষ্টির জন্য কিছু চাই, হোক্ তা দৃষ্টির আড়ালে। জগতে যত রকমের পরিবর্তন চলছে, তা প্রাকৃতিক হোক বা মানুষ দ্বারাই হোক। প্রকৃতপক্ষে, তা কিন্তু ভিন্ন-ধরনের পরিবর্তনের-ই ছায়া মাত্র। মানব-লোচনে ধরা না পড়তে পারে, তবে তা হচ্ছে অন্য কোথাও। জ্ঞানীরা, সেই ভিন্ন রকমের কর্ম বা কর্মের দ্বারা পরিবর্তনটি কোথায় হচ্ছে তাই জানায় মত্ত থাকেন।
.
পণ্ডিতদের শুষ্ক-পাণ্ডিত্যের দ্বারা সমাজের শুধু লাভই হয় তা বলা যায় না, অনেক বড় রকমের ক্ষতি হয়ে থাকে। জানার একটি বড়াই এসে যায়। অমুক বই তমুক বই পড়েছি। এতখানা বই পড়েছি, ইতিহাস ঘেঁটেছি, ধর্ম-শাস্ত্র ইত্যাদি গিলে ফেলছি - - - -ব্যস, এই হচ্ছে শুষ্ক-পাণ্ডিত্যের চরম অবস্থা!! তাই যতই বিদ্যা লাভ হোক না কেন, দেখা যায় অতীতের অনেক কিছুই ভুলে যান, নব নব প্রাপ্তির আনন্দে। আর তা থেকেই পণ্ডিতরা শ্রেণী গঠনে মেতে উঠেন। তার প্রভাব বা লক্ষণাদি হচ্ছে, সমাজের পিছিয়ে থাকা মানুষকে নিয়ে নাক-সিটকানো এবং অনেক মানসিক-যাতনা সইতে হয়, সে-সকল মানুষকে। কিন্তু জ্ঞানীরা বলেন ভিন্ন কথা। জ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, সকল প্রকার দানের অন্যতম হচ্ছে 'জ্ঞান-দান'। তাই পিছিয়ে থাকা মানুষকে, জ্ঞানের আলোকে আলোকিত করা, জ্ঞানীদের কর্তব্য বলেই মনে করেন। সকলের মঙ্গলে নিজের মঙ্গল, এ কেবল জ্ঞানীদের নিকট থেকেই শোনা যায়।
.
কিছু উদাহরণ দেখা যাক্, বর্তমান যুগে 'ধর্ম' এমন একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, এর পক্ষে ও বিপক্ষে, সমান তালে কথা চলছে। যখন কিছু মন্দ হয়, তাতে যদি ধর্মকে ব্যবহার করা হয়, তবে তা ধর্মের দোষ হয় কেন? বিশেষ বিশেষ কোনো গ্রন্থ-কে তো ধর্ম বলা হয় না। গ্রন্থ মানে গন্থ-ই। ধর্ম সে তো ভিন্ন বিষয়। ঐ সকল গ্রন্থে ভালো লেখা রয়েছে, কালে কালে তাতে অনেক সংযোজন বা বিয়োজন হয়ে, অতীতের প্রভাবশালীদের নানাবিধ চিন্তা-প্রণালী সংযোজিত হয়েছে। কিন্তু কালের যাত্রায়, সে-সকল বহিরাগতদের মতবাদ-ও বর্তমানের মানুষ 'ধর্ম' হিসেবে জেনেছে এবং পালন-ও করছে। আগামী হাজার বছর পর, আজকের দিনের অনেক ভালো বা মন্দ-ও, ধর্ম-গ্রন্থে সংযোজিত হতে পারে। এখন দেখা যাক, গ্রন্থ কেন ধর্ম নয়? যদি আপনার দেশের রাজধানীতে যাওয়ার জন্য, অনেকগুলো রাস্তা থাকে, এবং আপনি একটি গ্রন্থে কেবল একটি রাস্তার-ই সন্ধান পেয়ে থাকেন, আর যদি পরবর্তীতে জানেন যে, আরও অনেক রাস্তা দিয়েই রাজধানীতে যাওয়া যায়, তখন কি যে গ্রন্থটি আপনি পড়ে একটি রাস্তার সন্ধান পেয়েছিলেন, তাকেই একমাত্র সহায়ক হিসেবে গ্রহণ করবেন, চিরন্তন সত্য বলে গ্রহণ করবেন? আপনি চিন্তাশীল হলে তবে এই সিদ্ধান্তে আসবেন যে, ঐ গ্রন্থে কিছু ভালো কথা বা দিক নির্দেশনা ছিল। এবং ভবিষ্যতে যদি আরও অনেক রাস্তার সন্ধান পাওয়া যায়, তা-ও কোনো না কোনো গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হবে। কিন্তু মারামারির জন্য 'ধর্ম' নামের এই শব্দটির গায়ে কেন কলঙ্ক লেপে দেয়া হয়? আগুনে ঘর পোড়ে, কেউ আগুন ব্যবহার ছেড়ে দেয়ার কথা বলে না, জল-প্লাবনে জীবন নাশ হয়, সলিল-সমাধি হয়। তথাপি জল-মুক্ত জীবন কে চিন্তা করতে পারে? এই বিষয়গুলো পণ্ডিতরা এমনভাবে পরিবেশন করেন, যা দিয়ে কেবল নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়।
.
সমাজে পণ্ডিতদের প্রয়োজন রয়েছে। একটি নির্দিষ্ট সীমানাতে তাঁদের বিচরণ হলে সুন্দর দেখাবে। কারণ, তাঁরা যে শ্রেণী গঠন করেন!! ভয়ের কারণ ও সাময়িক ধ্বংসের-ও লুকানো হাতছানি। আর জ্ঞানীরা এসে সেই শ্রেণীকে ভাঙ্গেন। পিছিয়ে থাকা মানুষের দুর্ভোগ বাড়ানোর জন্য, শুষ্ক-পাণ্ডিত্য যথেষ্ট দায়ী। জ্ঞানীরা বলেন, যারা অবহেলিত নিষ্পেষিত, তাদের-কে যথাশীঘ্র আলোর নীচে আনতেই হবে। সেই সকল সাধারণ মানুষের ভাষাতেই যথাসম্ভব কথা বলতে হবে, যাতে করে সহজে বোধগম্য হয়। আর অবহেলিত সেই মানুষেরা যুগে যুগে সংখ্যায় বেশী থাকে। সেখানেই আসল শক্তি লুকিয়ে থাকে, যা অ-ব্যবহ্নত অবস্থায় থেকে যায়। জ্ঞানীদের সাথে পণ্ডিতদের পার্থক্য নতুন কিছু নয়। জ্ঞানীরা দেখেন, ভিতরের চোখে দিব্য দৃষ্টিতে। পণ্ডিতরা, দেখে চলছেন কেবলই বাহিরে চোখে।
Categories: Miscellaneous , Part-1
The words you entered did not match the given text. Please try again.
If you are the site owner, please renew your premium subscription or contact support.
Oops!
Oops, you forgot something.