|
আমাদের উৎসাহিত করা বংশীবাদকের প্রয়োজন। যার সুরের প্রবল টানে আমরা আবার নড়েচড়ে জেগে উঠব - বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম
.
বঙ্গবন্ধুকে হারিয়েছি অনেক দিন। নেতা ছাড়াই জীবনের বেশিদিন কাটিয়ে গেলাম। আমার বাবা, তার মা-বাবার ছায়া খুব বেশিদিন পাননি। দুই-আড়াই বছর বয়সে মা হারিয়েছিলেন। বাপ হারিয়ে ছিলেন ২৪-২৫ বছর বয়সে। আমি মা হারিয়েছি ৫৯-৬০ বছরে। বাবা পরলোকে গেছেন তারও ৪ বছর আগে। তাই বলতেই হয় বাবা-মা'র ছায়া পেয়েছি অনেক দিন। কিন্তু নেতার ছায়া পাইনি বেশিদিন। তিনি নিজে মরে আমাদের যে মেরে গেলেন, সে থেকে মুক্তি পেলাম না আজও। যন্ত্রণা সইতে সব সময় কষ্ট হয় না। কিন্তু মাঝে মধ্যে বড় বেশি কষ্ট হয়। যখন খুব বেশি অনিয়ম দেখি, তখন নিজেকে সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগের ছায়ায় বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার ছায়ায়-মায়ায় যারা আজকাল কেরদানি করে নানা ধরনের কথা বলে তখন বুকটা জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যায়। তাই সেদিন বিরোধী দলহীন সংসদে জাসদকে নিয়ে জাতীয় পার্টির বাহাস সম্পর্কে দু'কথা লিখেছিলাম। যার একটি কথাও আমার ছিল না, সবই ছিল বাস্তব ঘটনা। মঈন উদ্দিন খান বাদল যত হাত-পা-মাথা ঝাঁকিয়ে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে চৌদ্দবার বঙ্গবন্ধুকে 'বাপ বাপ' ডেকে যাই বলুন তাতে আমাদের সান্ত্বনা কোথায়? জনাব হাসানুল হক ইনু ইদানীং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা বলেন। মন্ত্রী হলে অনেক কথাই বলা যায় বা বলতে হয়। সন্ত্রাসই যার জীবন, তার মুখে সন্ত্রাসবিরোধী কথাবার্তা মানায় না। লিখেছিলাম নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের কথা। ওরকম শত শত খান সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তারা আজ প্রায় সবাই সরকারের বড় বড় স্তম্ভ। শাজাহান খানকে নিয়ে মাদারীপুর থেকে কয়েকশ টেলিফোন ও মেসেজ এসেছে। একজন লিখেছে, '86 Awami Legue leader and worker was killed by Sajahan khan and his gonobahini and now he becomes the minister. Whats the irony. Please write more and more. An admirer of you from Madaripur.'
.
আমি জানি না, জনাব খান ৮৬ জন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী হত্যার দায়ে দায়ী কি না! তবে এটা জানি তার নামে ২৮০টার ওপর হত্যা মামলা ছিল। সবই ছিল আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী হত্যার অভিযোগ। আমি সে কথাটাই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। সমস্যা হলো, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করলাম, দেশ স্বাধীন করলাম, স্বাধীনতার পরপরই যারা পাকিস্তানি ছিল তারা, আর আমরা এক হয়ে গেলাম। ডালে চালে খিচুড়ি। যে বাঙালি আর্মি মুক্তিযুদ্ধ করল, আর যারা করল না স্বাধীনতার পর তাদের এক শিবিরে বসবাসের ব্যবস্থা হলো। পুলিশ যারা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল, যুদ্ধ শেষে ফিরে এসে দেখল যারা পাকিস্তানের পক্ষে ছিল, সেই স্বাধীনতাবিরোধী আর মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ এক জায়গায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতার কারণে পাকিস্তানি দালালের কর্তৃত্ব নেতৃত্ব মেনে নিতে হলো মুক্তিযোদ্ধা পুলিশের। মুক্তিযুদ্ধের পরে যেমন হয়েছিল, এখন তার চেয়ে বেশি হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধীরা কয়েক বছরের মধ্যে যেমন সব কর্তৃত্ব নেতৃত্ব দখল করে নিয়েছিল, ঠিক তেমনি স্বাধীনতার পর যারা বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করেছে, বঙ্গবন্ধু সরকারের সর্বনাশ করেছে, হত্যা-ধ্বংস করেছে তারা এখন প্রায় সবাই বর্তমান সরকারের মধ্যমণি। স্বাধীনতার পর স্বাধীনতাবিরোধীরা যেমন জিয়াউর রহমানের হাত ধরে শক্ত মাটিতে পা রেখেছিল, ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধুর বিরোধী রাজনৈতিক খুনিরা বঙ্গবন্ধুর কন্যা, আমার ভগ্নী জননেত্রীর হাত-পা ধরে উচ্চাসনে আসীন হচ্ছেন- এটা সহ্য করতে সত্যি মন সায় দিতে চায় না।
.
দেশের মানুষ এক সময় মনে করত বঙ্গবন্ধুকে গালাগাল ও কটূক্তি করার জন্য মতিয়া চৌধুরীর ফাঁসি হবে, বড় বড় জাসদ নেতার কারাদণ্ড হবে কিন্তু তার বদলে তারা মন্ত্রিত্ব পাবেন, এটা কেউ কখনো ভাবেনি। আমরা বোকারা কেন যে এত কষ্ট করে 'বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু' করে জপতপ করে শত্রু হলাম বুঝতে পারি না। মুক্তিযুদ্ধ করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা নিঃস্ব-রিক্ত। বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ প্রতিরোধ করে প্রতিরোধ সংগ্রামী নির্যাতিত, নিষ্পেষিত, বঞ্চিত। দু-একজন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার আবদুল মালেকের মতো উপদেষ্টা হয়ে দেশের বারোটা বাজিয়েছেন। কিন্তু প্রকৃত অর্থে '৭৫-এর প্রতিরোধ সংগ্রামের কাউকে কোনো মূল্য দেওয়া হয়নি। আমাকে ছোটখাটো করার জন্য দু-চারবার দু-চারজন দালাল খোঁজা হয়েছে, তারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি ছাড়া তেমন কিছুই করতে পারেনি। যেহেতু সময় বয়ে যায় তাই দু-চার কথা না লিখে পারি না। ছেলেবেলায় পড়ালেখা করিনি, লেখালেখির গুরুত্ব বুঝিনি। জীবনে কত কষ্ট করেছি শুধু সেই কষ্টগুলো কলমের অাঁচড়ে ধরে রাখলেই রুটি-রুজির জন্য কোনো কষ্ট করতে হতো না। আজ কত নেতা, কত বীর, কিন্তু বঙ্গবন্ধু যেদিন নিহত হয়েছিলেন সেদিন মোহাম্মদপুরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোনো বীর খুঁজে পাইনি।
.
সব কথা একবারে বলা যাবে না। বলতে সময় লাগে। তবু প্রতিদিন বলে বলে অনেক কথাই শেষ করতে পারব বা করব। বঙ্গবন্ধু যখন নিহত হন তখন এসপি মর্যাদায় বিক্রমপুরের মহিউদ্দিন ছিলেন প্রধান দেহরক্ষী, তাকে সেদিন পাওয়া যায়নি। পুলিশের প্রধান ছিলেন নুরুল ইসলাম, বিডিআরের প্রধান মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান, বিমানবাহিনীর প্রধান এ. কে. খোন্দকার, নৌবাহিনীর প্রধানের এই মুহূর্তে নাম মনে পড়ছে না। রক্ষীবাহিনীর প্রধান নুরুজ্জামান দেশের বাইরে ছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক প্রধান তোফায়েল আহমেদ, পরিচালক আনোয়ার-উল-আলম শহীদ, সরোয়ার মোল্লা, মেজর হাসান- এরা কেউ বিপদগ্রস্ত বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধারে এগিয়ে যাননি। বরং সেনাবাহিনীর প্রধান জনাব শফিউল্লাহ জাতির পিতাকে বলেছিলেন, 'পিছন দরজা দিয়ে পালিয়ে যেতে পারেন কি না?' সেই শফিউল্লাহকে আওয়ামী লীগ এমপি বানিয়েছে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভাপতি বানিয়েছে। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জনাব শফিউল্লাহকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়েছিল। অনেক বছর বিদেশে রাষ্ট্রদূতের চাকরি করেছেন। স্বৈরাচার এরশাদের পতনের সময় তিনি লন্ডনে রাষ্ট্রদূত ছিলেন। আমি তখন লন্ডনে। প্রায় এক হাজার বাঙালি লন্ডন হাইকমিশনের সামনে অবস্থান করছিলাম। বঙ্গবন্ধুর ছবি তুলতে তিনি দেননি। ঢাকা থেকে নির্দেশ না পেলে তিনি ছবি তুলতে দেবেন না- এসব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জানতেন। তারপরও তাকে মনোনয়ন দিয়ে সংসদ সদস্য বানিয়েছেন, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভাপতি করেছেন। জনাব এ. কে. খোন্দকার সবার আগে ছুটে গিয়ে মোশতাকের প্রতি আনুগত্য জানিয়েছিলেন। তিনিও রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তিনিও আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি হয়েছেন, মন্ত্রী হয়েছেন। কি ভাগ্য! ব্যর্থতায় পুরস্কার, সফলতায় তিরস্কার আর নির্যাতন। মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান পাকিস্তান ফেরত দেশপ্রেমিক। মনে হয় বঙ্গবন্ধু তাকে জানতেন। শেষ পর্যন্ত বিডিআরের প্রধান ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর কিছুই করেননি, এক ফোঁটা চোখের পানিও ফেলেননি। তিনিও আওয়ামী লীগের নেতা হয়েছেন, মনোনয়ন পেয়েছেন।
.
কার কথা বলব, কত বলব? আমাদের বোধশক্তি অনেকটা ভোঁতা হয়ে গেছে। কর্নেল জামিল বলে এক ভদ্রলোক, তিনিও পাকিস্তান ফেরত। তাকে ডিজিএফআই-এর প্রধান করে ব্রিগেডিয়ার পদোন্নতি দিয়ে তিন হাজার চৌকস সৈন্য ও সব ধরনের অস্ত্রশস্ত্র সরঞ্জামাদি দিয়ে প্রেসিডেন্টকে রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তার বাহিনীর ব্যবহারের জন্য দুখানা হেলিকপ্টার দেওয়া হয়েছিল। তিন হাজার সৈন্যের এক হাজার গণভবনের আশপাশেই রাখা ছিল। একটা দেশের গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান এতকিছু হচ্ছে সবাই জানল, রাতে কেউ ঘুমালেন না, পরদিন শুক্রবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন, তার নিরাপত্তায় সবাই সক্রিয় কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান নাকে সরিষার তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ফোন পেয়ে ধড়ফড় করে জেগে এক কাপড়ে ছুটেছিলেন। মাঝপথে মারা পড়ে শহীদি দরজা পেয়ে গেলেন। বঙ্গবন্ধুর নিহত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তার ছবি জ্বল জ্বল করছে। হায়রে কপাল! যাকে দেখাশোনার দায়িত্ব দেওয়া হলো। দায়িত্ব অবহেলা করে ঘুমিয়ে রইলেন, একা এসে মরণের ভান করে হিরো হলেন। এত ষড়যন্ত্র হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রান্ত হবে তারই তো আগে জানার কথা ছিল, তারই তো প্রতিরোধ করার কথা। তাকে চৌকস দক্ষ যোগ্য ভাবতাম যদি খুনিদের মাঝপথে বাধা দিতেন, ষড়যন্ত্রকারীদের বন্দী করতেন, একেবারেই ওসব কিছু না পারলেও সময়মতো একটা কোম্পানি নিয়ে খুনিদের আগেই বঙ্গবন্ধুর বাড়ি রক্ষায় প্রতিরক্ষা বূ্যহ রচনা করতেন, একেবারে কোনো কিছু না করতে পারলেও একা না এসে দু-একশ সৈন্য নিয়ে খুনিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেন, তাহলেও না হয় ভাবতাম তিনি সদাপ্রস্তুত ছিলেন। এমন অলস মেধাহীন ডিজিএফআই'র প্রধান ছিলেন বলেই আমরা বঙ্গবন্ধুকে হারিয়েছি। দেশের এই সর্বনাশের যদি বিচার হতো ভবিষ্যতে সবাই দায়িত্ব পালন করত। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে ব্রতী হতো। সব ন্যায়নীতি ধসে পড়ায় মানুষ কেমন যেন ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছে। জাতি নিরুৎসাহিত হলে তারচেয়ে বড় ক্ষতি আর নেই। আমাদের উৎসাহিত করা বংশীবাদকের প্রয়োজন। যার সুরের প্রবল টানে আমরা আবার নড়েচড়ে জেগে উঠব।
Categories: None
The words you entered did not match the given text. Please try again.
If you are the site owner, please renew your premium subscription or contact support.
Oops!
Oops, you forgot something.