|
ক্ষমতার রাজনীতি ও তার পরিণতি
.
বাংলাদেশের রাজনীতির যেকোনো নিবিড় পর্যবেক্ষকই দ্বিমত করবেন না যে আমাদের রাজনীতিবিদেরা ক্ষমতার রাজনীতিতে বিভোর৷ তাঁরা যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় যেতে বদ্ধপরিকর৷ দলে গণতন্ত্রচর্চার মতো যেসব গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ রাষ্ট্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য, সেগুলো থেকে তাঁরা বহু দূরে৷ কিন্তু কেন? তার পরিণতিই বা কী? রাজনীতির যেসব গুরুতর সমস্যার কথা অধ্যাপক রওনক জাহান হাজির করেছেন, তার অধিকাংশই রোগের উপসর্গমাত্র৷ তবে রোগের চিকিৎসার জন্য রোগের কারণ চিহ্নিত করা জরুরি৷ আমাদের ধারণা, দুর্নীতিই আমাদের বিরাজমান ক্ষমতার রাজনীতির প্রধান কারণ৷ জনকল্যাণের পরিবর্তে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর কল্যাণই ক্ষমতায় যাওয়ার প্রধান আকর্ষণ৷ তাই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় সর্বস্তরে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের মূলোৎপাটন করা আমাদের অন্যতম জাতীয় অগ্রাধিকার৷
.
ক্ষমতায় গিয়ে লুটপাট করা যায় এবং সেই লুটপাটের ফসল প্রায় নির্বিঘ্নে ভোগ করা যায়৷ আনুগত্য ‘ক্রয়’ বা অব্যাহত রাখার জন্য ফায়দা হিসেবে তা ব্যবহারও করা যায়৷ এ কারণেই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত এবং ক্ষমতার আশপাশে থাকা ব্যক্তিরা, সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, বৈধ আয়ের উৎস ছাড়াই অঢেল অর্থবিত্তের মালিক৷
.
লুটপাট করার ও অন্যায় ফায়দা বিতরণের জন্য শাসক শ্রেণির কাউকে সাধারণত জেলে যেতে হয় না৷ অর্থ ও তদবিরের বিনিময়ে তাঁরা পার পেয়ে যান৷ কিংবা তাঁদের বিরুদ্ধের মামলা ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ প্রত্যাহার করা হয়৷ রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও এসব দুর্বৃত্তের তেমন কোনো মাশুল গুনতে হয় না৷ তাই লুটপাটতন্ত্র কায়েম এবং আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা ভোগই ক্ষমতায় যাওয়ার উম্মত্ত প্রতিযোগিতার প্রধান কারণ বলে আমাদের বিশ্বাস৷
.
৪৩ বছরের ইতিহাসে একমাত্র সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ছাড়া আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতাধর ব্যক্তিকেই দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে জেল খাটতে হয়নি৷ তবে দুর্নীতির অভিযোগে জেল খাটলেও এরশাদ রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে নির্বাসিত হননি; বরং তিনি আমাদের রাজনীতিতে ‘কিং-মেকারে’ পরিণত হয়েছেন৷ আমাদের প্রধান দুটি দলই—আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এরশাদের সমর্থন পাওয়ার জন্য এখনো প্রতিযোগিতায় লিপ্ত৷ প্রসঙ্গত, নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের প্রাক্কালে প্রণীত তিন জোটের রূপরেখায় আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ অন্য প্রধান দলগুলো এরশাদের দল জাতীয় পার্টির সঙ্গে ভবিষ্যতে কোনো ধরনের সমঝোতা না করার অঙ্গীকার করেছিল৷
.
দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক কাঠামোতে ছলে-বলে-কলে-কৌশলে ক্ষমতা ‘দখল’ করলেই হয় না, ক্ষমতায় টিকে থাকতে হয়৷ আর ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রয়োজন পড়ে৷ সে কারণেই দল ও সব রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আমাদের দেশে দুই ব্যক্তি ও তাঁদের পরিবার বা একান্ত অনুগতদের হাতে কুক্ষিগত৷ আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোয় ব্যক্তিতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্রের অনপুস্থিতি এ ব্যবস্থারই প্রতিফলন৷
.
রাষ্ট্রীয় বৈধ ক্ষমতা অবৈধভাবে ব্যবহার করা গেলে দুই ক্ষমতাকেন্দ্রের মধ্যে বিরাজমান ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়৷ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দলীয়করণের মাধ্যমে এ ভারসাম্য নষ্ট ও ক্ষমতা অপব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হয়৷ আর ভারসাম্য নষ্ট হলে সমঝোতা ভেঙে যায় এবং বিভিন্ন ধরনের কূটকৌশল অবলম্বন করে ক্ষমতাসীনেরা ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার পাঁয়তারা করেন, যা ঘটেছিল ২০০৬ সালে৷
.
রাষ্ট্রীয় বৈধ ক্ষমতা অবৈধভাবে ব্যবহার করা গেলে সে ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা যায়, এমনকি নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টাও চালানো যায়৷ র্যাবকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার এর একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত৷ ২০০৪ সালে র্যাব সৃষ্টি করা হয় মূলত ফায়দা প্রদান ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্ট সন্ত্রাসীদের শায়েস্তা করার লক্ষ্যে৷ কিন্তু দলীয়করণের কারণে র্যাব ক্রমাগতভাবে দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত হতে থাকে, যার নগ্নতম প্রতিফলন ঘটে গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সময়ে৷ অন্যায়ভাবে এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহারের মাধ্যমে র্যাবের শৃঙ্খলা বহুলাংশে ভেঙে পড়ে এবং এ বাহিনীর কিছু সদস্যের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা সৃষ্টি হয়৷ নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা এ প্রবণতারই প্রতিফলন বলে আমাদের ধারণা৷
.
রাজপথে সহিংসতা সৃষ্টির ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো মাস্তান পোষে, সরকারি দলের পক্ষে যা করা অপেক্ষাকৃত সহজ৷ অনেক দিন থেকেই আমাদের রাজনীতিতে তা চলে আসছে৷ ফায়দাতন্ত্রের সম্প্রসারণের ফলে মাস্তানের সংখ্যাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ আর এ মাস্তানদের অনেকেই বর্তমানে মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন এবং নির্বাচনী অঙ্গনে প্রবেশ করছেন৷ চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও দখলদারত্ব ইত্যাদি অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক বনে যাওয়া এসব মাস্তানের অনেকেই এখন তাঁদের পুরোনো রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় রাজনীতির মাঠ থেকে বিতাড়িত করছেন৷ এসব মাস্তানের কেউ কেউ টাকা ও পেশিশক্তি খাটিয়ে এখন মন্ত্রী, এমপি, উপজেলা বা পৌরসভার চেয়ারম্যান, সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ইত্যাদি পদে অধিষ্ঠিত হচ্ছেন৷ ফলে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কারণে রাষ্ট্র আজ, প্রয়াত বিচারপতি হাবিবুর রহমানের ভাষায়, ক্রমাগতভাবে ‘বাজিকরদের’ হাতে চলে যাচ্ছে, যা এক ভয়াবহ অশনিসংকেত৷
.
রাজনৈতিক দলে ব্যক্তি ও পরিবারতন্ত্র জেঁকে বসার ফলে এমনিতেই রাজনীতিতে মেধাবী ব্যক্তিদের প্রবেশের পথ অনেকটাই রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে৷ রাজনীতিতে ক্রমাগতভাবে মাস্তানতন্ত্রের বিস্তারের কারণে সৎ, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত ব্যক্তিরা এ অঙ্গন থেকে ভবিষ্যতে সম্পূর্ণভাবে বিতাড়িত হবেন৷ এর ফলে দেশে ক্রমবর্ধমানহারে অযোগ্য ও অবাঞ্ছিত ব্যক্তিদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, যা জাতির জন্য কোনোভাবেই কল্যাণ বয়ে আনবে না৷ এমন পরিস্থিতিতে আমাদের রাজনীতিবিদদের জন্য ভবিষ্যতে আরও কঠিন সময় অপেক্ষা করছে৷ এ ছাড়া চাঁদা-টেন্ডার তথা ফায়দা প্রাপ্তির প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হবে এবং সরকারি দলের অভ্যন্তরে খুনখারাবি আরও বাড়বে৷
.
আর দেশে অযোগ্য, অদক্ষ, দুর্নীতিবাজ ও অবাঞ্ছিত ব্যক্তিদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে এর মাশুল পুরো জাতিকেই দিতে হবে৷ কারণ, অপরাধীদের শাসন দেশে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে, যা ভবিষ্যতে উগ্রবাদী শক্তির উত্থানের পথকে সুগম করবে৷ ধর্মাশ্রিত শক্তি এরই মধ্যে এই উপমহাদেশে তাদের কুৎসিত চেহারা প্রদর্শন করা শুরু করেছে৷ বিরাজমান পরিস্থিতি ভবিষ্যতে বাংলাদেশে উগ্রবাদের বিস্তারকে আরও ত্বরান্বিত করবে বলেই আমাদের আশঙ্কা৷
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন৷
Categories: __________Chapter-IV
The words you entered did not match the given text. Please try again.
If you are the site owner, please renew your premium subscription or contact support.
Oops!
Oops, you forgot something.