|
শুক্রবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। ঢাকায় ফিরবো। ঢাকার কাছের এক উপজেলার বাস কাউন্টারে দাড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছি।
.
রাত প্রায় সাড়ে আটটা বেজে গেছে। জানলাম জেলা শহর থেকে বাস আসতে দেরী হবে। পথে একটা ট্রাক খাদে পড়ায় রাস্তায় ভয়াবহ জ্যাম লেগে গেছে।
.
বাস কাউন্টারের কাছাকাছি চায়ের টং দোকানে দাড়ালাম। চায়ে চুমুক দিতে দিতে লক্ষ করলাম এক কিশোর বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছে। কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু চোখাচোখি হতে অপ্রস্তুত হয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। আবার চোখাচোখি হতেই আমি মৃদু হেসে দিলাম। ইশারায় কাছে ডাকলাম। কিশোর এগিয়ে এলো।
.
আমিঃ নাম কি তোমার?
সেঃ তাজু হুশেন।
আমিঃ সমস্যা কি? চা খাবা?
তাজুঃ স্যার, আমারে তিরিশ টাকা দিবেন?
আমিঃ তিরিশ টাকা দিয়া আপনি কি করবেন, স্যার?
তাজুঃ পোলাও (তেহারী) খামু। সারাদিন কিছু খাই নাই।
আমিঃ তিরিশ টাকা দিয়া পোলাও পাইবেন কোনখানে?
তাজুঃ আমার কাছে ২০ টাকা আছে। ঐ হোটেলে কইছে ৫০টাকায় খাইতে দিবো। স্যার দিবেন আমারে ৩০ টাকা? পোলাও খামু।
আমিঃ চলেন হোটেলে যাই।
.
আমি আর তাজু রাস্তা পার হয়ে হোটেলে ঢুকলাম। হোটেলের কড়া আলোয় তাজুকে পস্ট দেখলাম। বয়স তেরো থেকে চৌদ্দ বছর হবে। মুখ অসম্ভব মলিন। চুল ছোট করে কাটা, তেলে আর ধুলায় চিকচিক করছে। অসম্ভব মায়াভরা দুটা চোখ। চোখ দেখে মনে হচ্ছে কিছুক্ষন আগেও কান্না করেছে। গায়ে সাদা রঙ্গের হাফ হাতা শার্ট। শার্টের বোতামগুলা লাল। ছাই রঙ্গের একটা বিবর্ন প্যান্ট পরেছে। পায়ে প্লাস্টিকের স্যান্ডেল।
.
তাজুর কাছে জানতে চাইলাম সে মুরগি না গরুর গোশতের পোলাও খাবে। হোটেলের বয় আমাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এলো। জানালো সন্ধ্যায় ৭০ টাকা দামের হাফ প্লেট গরুর তেহারী তাজুকে ৫০ টাকায় দিতে তারা রাজী হয়েছিলো। আমি তাজুর কাছে জানতে চাইলাম সে কোনটা খাবে। তাজু পছন্ড করলো মুরগি। খুব তৃপ্তি নিয়ে ও খাচ্ছে। আমি কোন কথা না বলে ওকে আর ওর খাওয়া দেখতে থাকি। কেনো যেনো মনে হলো ওর চোখ বারবার ছলোছলো হয়ে উঠছে।
.
খাওয়া শেষে আলাপ শুরু করলাম। যা জানলাম তা খুব সাদামাটা ঘটনা। তাজুর বাবা তিন বছর আগে আর একটা বিয়ে করে চলে গেছেন। তাজুর মা বুয়ার কাজ করেন। ওরা থাকত রেললাইন বস্তিতে। কিছুদিন আগে বস্তির একজন দিনমজুর তাজুর মা'কে বিয়ে করেছেন। তারপর থেকে তাজু গাড়িতে গাড়িতে চকলেট বেচে। সদরঘাট টার্মিনালের সিড়িতে রাতে ঘুমায়। আর দুই তিন দিন পরপর যখন নতুন বাবা ঘরে থাকেনা তখন মায়ের সাথে দেখা করে। চকলেট বিক্রির টাকা থেকে মা'কে খিলি পান কিনে দেয়।
.
আজ তাজুর ভালো লাগছিলোনা। তাই সকাল সকাল মায়ের কাছে গিয়েছিলো। নতুন বাবা তখনো কাজে যায় নাই। মা গায়ে হাত দিয়ে দেখেছে তার অনেক জর, মাথায় পানি ঢেলে তেল মেখে দিয়েছে। মাকে ছেড়ে আসতে ওর ইচ্ছা করছিলোনা। মায়ের কাছে থাকার আব্দার করেছিলো। এই আব্দার নতুন বাবার পছন্দ হয় নাই। তিনি ওর গালে জোড়ে থাপ্পর মেরেছেন। তারপর তাজুলের ভাষায় 'গেটি ধইররা খেদায়া দিছে।'
.
তাজু তার ছোট্ট বুকে বিশাল কষ্ট চেপে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছে। শেষে গুলিস্থান থেকে বাসে চেপে এখানে এসেছে। চকলেট বিক্রির মূলধন ৫০ টাকা থেকে ৩০ টাকা ভাড়া দিয়েছে আর ২০ টাকা রেখেছিলো ফিরার ভাড়া বাবদ। রাগে কষ্টে সারাদিন কিছু খায় নাই। ক্ষুদা সহ্য করতে পারছিলোনা। তাই বিশ টাকা খরচ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো।
.
হোটেল থেকে বেড় হয়ে আসি। রাস্তা পাড় হয়ে একটা কনফেকশনারীতে ঢুকি। তাজুও সাথে সাথে আসে। ওকে এক প্যাকেট চকলেট কিনে দেই। কাল সে বিক্রি করবে। বাসে উঠে বসি। বাস ছাড়তে না ছাড়তে তাজু আমার গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পরে। নিজের অজান্তে ওর কপালে হাত রাখি। বুঝতে পারি বেশ জর।
.
রাষ্ট্র তোমার কত রকম বায়নাক্কা, খেমটা তালে ঝুমুর ঝুমুর কত রকম নর্তন কূর্দন। শিশুরা জাতীর ভবিষ্যত, শিশু অধিকার, সার্বজনিন শিশু শিক্ষা, শিশু দিবস কত রকম ভুজং ভাজুং। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান শিক্ষা রাষ্ট্রের প্রতিটা নাগরিকের মৌলিক অধিকারের সাংবিধানিক লারেলাপ্পা। অথচ বাস্তব চিত্র হলো এই রাষ্ট্রের অধিকাংশ শিশুরা খেটে খায়, খেটে বাচে, খেটে মরে। তারা নিজেদের অধিকার আদায়ে রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করেনা, সংবিধানের দিকে আঙ্গুল তুলেনা, মানচিত্র চিবিয়ে খেতে চায় না।
.
বাস ঢাকার দিকে ছুটছে। তাজু ঘুমাছে। তাজুরা ঘুমিয়ে থাকলেই রাষ্ট্র নিরাপদ ও রাষ্ট্রের মঙ্গল। তাজুরা চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে গেলে রাষ্ট্র আরো বেশী নিরাপদ, রাষ্ট্রের চিরস্থায়ী মঙ্গল।
Categories: ____Poverty in Bangladesh
The words you entered did not match the given text. Please try again.
If you are the site owner, please renew your premium subscription or contact support.
Oops!
Oops, you forgot something.