|
সাকরাইন : পুরান ঢাকার পৌষসংক্রান্তি উৎসব
.
আবু সাঈদ আহমেদ
.
পৌষসংক্রান্তি অর্থাৎ পৌষ মাসের শেষ দিন পুরান ঢাকার আকাশ থাকে ঘুড়িদের দখলে। আকাশজুড়ে নানান রং আর বাহারের ঘুড়িদের সাম্যবাদ। এক সপ্তাহ ধরে পুরান ঢাকার বাহান্ন রাস্তা তেপান্ন গলির এবশির ভাগ গলিতে আর খোলা ছাদে চলছে সুতা মাঞ্জা দেওয়ার ধুম। রোদে সুতা শুকানোর কাজও চলেছে পুরোদমে। যদিও মাঞ্জার স্থান দখল করে নিচ্ছে রক সুতা নামের এক ধরনের সুতা। শীতের উদাস দুপুর আর নরম বিকেলে আকাশে গোত্তা খাচ্ছে নানান রঙের ঘুড়ি। ঘুড়িতে ঘুড়িতে হৃদ্যতামূলক কাটা-কাটি খেলাও চলছে। অহরহ কাটা-কাটি খেলায় হেরে যাওয়া অভিমানী ঘুড়ি সুতার বাধন ছিঁড়ে উড়ে যাচ্ছে দূরে।
.
পৌষ মাসের শেষ দিন অর্থাৎ পৌষসংক্রান্তির দিনই পালিত হয় পুরান ঢাকার এবং আদি ঢাকাইয়াদের ঐতিহ্যের সাকরাইন উৎসব। ভোরবেলা কুয়াশার আবছাতেই ছাদে ছাদে শুরু হয় ঘুড়ি ওড়ানোর উন্মাদনা। ছোট-বড় সবার অংশগ্রহণে মুখরিত থাকে প্রতিটি ছাদ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে উৎসবের জৌলুস। আর শীতের বিকেলে ঘুড়ির কাটা-কাটি খেলায় উত্তাপ ছড়ায় সাকরাইন উৎসব। এক দশক আগেও ছাদে ছাদে থাকতো মাইকের আধিপত্য। আজ মাইকের স্থান দখল করেছে আধুনিক সাউন্ড সিস্টেম। উৎসবের আমেজ থাকবে পুরান ঢাকার সর্বত্র। গেন্ডারিয়া, তাঁতীবাজার, লক্ষ্মীবাজার, চকবাজার, লালবাগ, সূত্রাপুরজুড়ে ঐতিহ্যের এই উৎসবে। আকাশে ঘুড়ি আর বাতাসে দোলা জাগানো গান। মাঝেমধ্যে ঘুড়ি কেটে গেলে পরাজিত ঘুড়ির উদ্দেশে ধ্বনিত ভাকাট্টা লোট শব্দ যুগল।
.
সাকারাইন উৎসব এখন আর শুধু ঢাকাইয়াদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সাকরাইন পুরান ঢাকায় বসবাসকারী সব মানুষের উৎসবে পরিণত হয়েছে। পুরান ঢাকার এসব ঐতিহ্য সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে সচেতন এবং ঐতিহ্যগুলো পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষে আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন। উল্লেখ্য, পুরান ঢাকার সার্বজনীন উৎসব ঈদ মিছিল, বৈশাখী মেলা আর সাকরাইন উৎসব। আশার কথা, পুরান ঢাকার ঐতিহ্য পুনরুজ্জীবন, সংরক্ষণ এবং জনপ্রিয় করার লক্ষে বর্তমান প্রজন্ম সচেতন। অতীতে সাকরাইনে পুরান ঢাকায় শ্বশুরবাড়ি থেকে জামাইদের নাটাই, বাহারি ঘুড়ি উপহার দেওয়া এবং পিঠার ডালা পাঠানো ছিল অবশ্য পালনীয় অঙ্গ। ডালা হিসেবে আসা ঘুড়ি, পিঠা আর অন্যান্য খাবার বিলি করা হতো আত্মীয়স্বজন এবং পাড়ার লোকদের মধ্যে। নীরব প্রতিযোগিতা চলত কার শ্বশুরবাড়ি থেকে কত বড় ডালা এসেছে। আজ এই সব চমৎকার আচারগুলো বিলুপ্ত হতে চলেছে। পুরান ঢাকার আদি বসবাসকারী সব মানুষ এই ঐতিহ্যগুলোর স্মৃতি রোমন্থন করেন। নতুন প্রজন্মকে শোনান সেই সব মুখরিত দিনের কথা। মনের খুব গভীরে পরম মমতায় লালন করেন ঐতিহ্যের পরম্পরা। স্বপ্ন দেখেন এসব প্রাণময় ঐতিহ্য আবার পুনরুজ্জীবিত হবে।
.
পৌষসংক্রান্তির সন্ধ্যায় আঁধার ঘনাবার সঙ্গে সঙ্গে পুরান ঢাকা সব জঞ্জাল আর কালিমা পুড়িয়ে ফেলার আর আতশবাজির খেলায় (ইংরেজিতে যাকে বলে ফায়ার ওয়ার্কস) মাতে। রাতে কেউ কেউ ওড়ায় ফানুস। সাকরাইন এমনই সুন্দর আর অর্থপূর্ণ ঘুড়ি উড়ানোর উৎসব।
.
পুনশ্চ : ১.ঢাকাইয়াদের ভাষায় ঘুড়িকে বলে ঘুড্ডি বা গুড্ডি। ঘুড়ি উড়ানোর জন্য সূতাকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ধারালো করা হয়। ধারালো করার এই প্রক্রিয়াকে বলে মাঞ্জা । ঘুড়ির কাটাকাটি খেলায় কোনো ঘুড়ি কেটে গেলে বলা হয় বাকাট্টা লোট। বিভিন্ন রকমের বা ডিজাইনের ঘুড়ি পাওয়া যায় যেমন চোখদার, মালাদার, ঘায়েল, দাবা প্রভৃতি। এবার যুক্ত হয়েছে রংধনু মার্কা।
.
২. সাকরাইন শুধু ঘুড়ি উড়ানোর উৎসব নয়। পুরান ঢাকার ঘরে ঘরে চলবে মুড়ির মোয়া, ভেজা বাখরখানি আর পিঠা বানানোর ধুম।
৩. কয়েক বছর ধরে ছোট আকারের লাটাই পাওয়া যাচ্ছে। এই ছোট আকারের লাটাই হাতে নিয়ে সাকরাইনের উন্মাদনায় ঢাকার আগামী প্রজন্মের প্রতিনিধিরা জানান দেয় তাদের উচ্ছ্বাস ও আনন্দ।
Categories: Brief Stories, Part -1
The words you entered did not match the given text. Please try again.
If you are the site owner, please renew your premium subscription or contact support.
Oops!
Oops, you forgot something.