|
দুই নারী, দুটি ধর্ষণ এবং দুটি দল
.
ক্ষমতাকেন্দ্র রাজধানীতে বসে দুই নারী যুদ্ধ করছেন; জনগণের হাত-পা বাঁধা। যশোরে মা ও মেয়ে একত্রে ধর্ষিত হয়েছেন, বাবা-ভাই হাত-পা বাঁধা অবস্থায় তা সহ্যকরেছেন। আত্মরক্ষার কোনো সহায় তাঁদের ছিল না। যদি সিনেমার মতো সমান্তরালে জাতীয় ও পারিবারিক দুটি কাহিনি দেখি, তাহলে হয়তো ঘটনা দুটিকে বিচ্ছিন্ন বলে মনে হবে না।
.
দুই দিকে দুটি আয়োজন চলছিল। জাতিসংঘের দূত তারানকো যখন ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে নেতা-নেত্রীদের সঙ্গে বৈঠক চালাচ্ছিলেন, তখন যশোরের মনিরামপুর উপজেলায় ১০ জন পুরুষ একজোট হচ্ছিল। রাতের ঢাকায় যখন দিনের শেষ ককটেলটি ফুটছিল, তখন যশোরের একটি বাড়ির দরজা ভাঙা হচ্ছিল। দুই নেত্রী এবং তাঁদের নায়েব-উজির-সিপাহসালাররা যখন ঘুমের আয়োজন করছেন, তখন হাত-পা বাঁধা হচ্ছিল মায়ের স্বামী-পুত্রের এবং বোনের বাবা-ভাইয়ের। বিটিভিতে তখন আমাদের বিষণ্ন সুন্দর জাতীয় সংগীতের শেষ চরণটি বাজছিল, ‘ওমা তোর বদনখানি মলিন হলে, আমি নয়নজলে ভাসি’, তখন মাতৃজাতির মেয়েটিকে মায়ের ঘরে আর মাকে উঠানে রাখা চৌকিতে চরম নির্যাতন করা হচ্ছিল। যখন টক শোয়ে মাতোয়ারা হচ্ছিলেন আলোচক ও দর্শক, তখন বাবা-ভাই হাত-পা বাঁধা অবস্থায় দর্শক হচ্ছিলেন নিজেরই স্ত্রী-কন্যা, মা-বোনের ধর্ষণযজ্ঞের।
.
যা দেখার নয়, যা সহ্য করার নয় তা যখন দেখতে ও সইতে হচ্ছিল তাঁদের, তখন দেশবাসীও যা দেখার কথা ছিল না, তেমন রাজনীতির অসহায় দর্শক হয়ে থাকছিলেন। আমরা সবাই যেন ভয়াবহ নির্যাতনের সাক্ষী শুধু নই, আমরা নিজেরাও এর শিকার। নিজ গৃহে নিজেরই কন্যা-জায়া-জননীর ওপর পাশবিক নির্যাতন যতটা মর্মান্তিক; জনপ্রিয় দুই নেত্রীর দেশবাসীর এই দুর্ভোগ চেয়েচেয়েদেখা ততই দুঃখজনক। যে দেশের নেতা-নেত্রীরা এ রকম দায়িত্বহীন, সেই দেশের ভয়ার্ত গ্রামবাসীর ঘুম ভাঙে ধর্ষিতা আর তাঁদের স্বজনের আর্তনাদে। সেই অক্ষম আর্তনাদে কেঁপে ওঠেনি বঙ্গভবন, কালো হয়ে যায়নি শুভ্র সংসদ ভবন, লজ্জিত হয়নি জাতীয় পতাকা, থমকে যায়নি রাজনীতির ইয়াজুজ-মাজুজেরা। কেবল শহীদ মিনারই অধোবদন।
.
সারা দেশে যা হচ্ছে, যশোরের মনিরামপুরে সেটাই হচ্ছে। তবে তার থেকে কিছু বেশি। সেখানে সাংবাদিকও যেতে পারেন না, সড়কে গাছের গুঁড়ির বাধা যদিওবা পেরোতে পারেন, পিকেটারদের আগুনে মোটরসাইকেল পোড়ানো ঠেকাবেন কীভাবে? পুলিশও সেখানে যেতে ভয় পায়। ধর্ষকদের বিরুদ্ধে মামলা, তদন্ত, বিচার—সব তাই থমকে থাকবে। জাতীয় সমস্যার মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত পুলিশ ব্যস্ত থাকবে বিরোধী ঠেকাতে, কিন্তু সাধারণ মানুষ কি ততক্ষণ নিঃশ্বাস বন্ধ করে থাকবে? এই পরিস্থিতিই তো সুবর্ণ সুযোগ দুর্বৃত্ত ও দস্যুদের।
.
সংবাদটি গণমাধ্যমে সামান্য গুরুত্বই পেয়েছে। অথচ এটাই হতে পারত আজকের জাতীয় পরিস্থিতির শিরোনাম, প্রধান সংবাদ। যদি হতো, তাহলে হয়তো অনেকেরই অনুভূতিতে কাঁপন ধরত। অনেকেই ক্রোধে ফেটে পড়তেন। কিন্তু তা হয়নি। এ রকম অরাজনৈতিক ‘মানবিক কাহিনি’র দাম এখন কম। এখন এরশাদ কাহিনি, সুজাতা-তারানকো কাহিনি, হাসিনা-খালেদা কাহিনির রমরমা। দুই দল ক্ষমতার পাঞ্জা লড়ছে। এ অবস্থায় মা ও মেয়ের ধর্ষণ তো অরাজনৈতিক ‘হিউম্যান স্টোরি’, নিতান্তই একটি গরিব পরিবারের পারসোনাল ট্র্যাজেডি।
.
ওই ১০ ধর্ষকের যে ছয়জন মাকে নিপীড়ন করেছিল, আর যে চারজন কন্যাকে চরম সহিংসতার শিকার করছিল, তারা সংসদে সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘু দলের প্রতিনিধি কি না, আমরা জানি না। তবে এটা বলতে পারি, তারা প্রথম ধর্ষণটি ঘটায় দেশের প্রতীক মায়ের সঙ্গে। দ্বিতীয় ধর্ষণটি ঘটে কন্যাটির ওপর, যে হতে চাইছিল ভবিষ্যৎ। এই বাস্তবতায় দুই নারী যেন আমাদের দেশ ও ভবিষ্যতেরই প্রতীক।
.
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com
Categories: Miscellaneous , Part-1
The words you entered did not match the given text. Please try again.
If you are the site owner, please renew your premium subscription or contact support.
Oops!
Oops, you forgot something.